Thursday, January 5, 2012

স্কুলগুলোকে শিক্ষামন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারিভর্তিতে নেওয়া বেশি টাকা ফেরত না দিলে রেজিস্ট্রেশন বাতিল

চলতি বছরের ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়া স্কুলগুলোকে বাড়তি টাকা ফেরত দিতে হবে। টাকা ফেরত না দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হবে না। তাদের স্বীকৃতি ও রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রী এ কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
গতকাল বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধকরণ-সংক্রান্ত বৈঠকে আলোচনায় ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বক্তব্য শুনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, 'এটা কেবল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বাস্তবায়ন হবে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আমার (শিক্ষা) পরিবারে কলঙ্ক লাগতে পারে না।'
শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের সচিব, মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তর এবং রাজধানীর নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক কক্ষে সাংবাদিকদের থাকতে দেওয়া হয়নি। বৈঠকে অংশ নেওয়া বিভিন্ন সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব বিষয় নিশ্চিত করেছে। পরে কালের কণ্ঠের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিবের আলাপচারিতায়ও এসব কথা উঠে আসে।
চলতি বছর ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এ ছাড়া রাজধানীর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ভর্তিতে বেশি টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বৈঠকে মন্ত্রী এ তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে জানতে চান-কেন এবং কার আদেশে নীতিমালার বাইরে ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়া হলো? জবাবে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা জানান, পরিচালনা কমিটির সুপারিশেই বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে দুটির সভাপতিই স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং একটির সভাপতি ঢাকার জেলা প্রশাসক। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের এমন বক্তব্যে মন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, 'আপনারা পেয়েছেন কী? যার যার ইচ্ছেমতো টাকা নেবেন? কোনো নীতিমালা মানবেন না? আপনাদের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য পুরো শিক্ষা পরিবারের ওপরে কলঙ্ক লাগবে, তা আমি সহ্য করব না।'
বৈঠকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন একটি প্রতিবেদন দিয়ে বলেন, 'চলতি বছরের ভর্তিতে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাংলা মাধ্যমে ১৩ হাজার ৭৭৫ টাকা নিচ্ছে। আর ইংলিশ ভার্সনে এই টাকার সঙ্গে আরো সাত হাজার টাকা যোগ করে নেওয়া হচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠানের বনশ্রী শাখায় নেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকা এবং মুগদা শাখায় নেওয়া হচ্ছে দুই লাখ টাকা।' এ পর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রী অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগমের কাছে জানতে চান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে কার আদেশে নীতিমালার বাইরে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে? জবাবে শাহান আরা বলেন, পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য এ রকম টাকা নেওয়া হচ্ছে। বৈঠক থেকে বেরিয়ে এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
পরে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননের কাছে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মানসম্মত শিক্ষা দেওয়ার জন্য এ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য বলে, আমরা ফেরত দেব।' এই বেশি টাকা নেওয়াকে অন্যায় নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'প্রতিষ্ঠানের ডোনেশন ফি হিসেবে দুই লাখ এবং উন্নয়ন ফি হিসেবে ২০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত।' তাঁর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষা বোর্ডে কোনো আইনেই এ টাকা নেওয়ার বৈধতা দেওয়া হয়নি।'
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিওদের মোচ্র্চা 'গণস্বাক্ষরতা অভিযান' প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো না কোনোভাবে এসব ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকতেই হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যদি নিয়মের মধ্যে আনা যায়, এসব বিদ্যালয়গুলোকে কেন আনা যাবে না? এসব মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে নিয়মের ভেতরে আনার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর এমন ঘোষণাকে আমি সমর্থন করি, স্বাগত জানাই।' তিনি বলেন, 'মূল ধারার বিদ্যালয়, যারা বোর্ডের বই পড়ায়, তারা কেন এ রকম ব্যবসা করবে। ব্যবসা করার জন্য ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে।' তিনি বলেন, যত বাধাই আসুক না কেন, এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে, এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এসব প্রতিষ্ঠান রীতিমতো ব্যবসা করছে। তাদের এ ব্যবসা বন্ধ করার জন্যই শিক্ষামন্ত্রী এ উদ্যোগ নিয়েছেন। মন্ত্রীর এ উদ্যোগের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা ফেরত দিতেই হবে। নতুবা-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মাশুল দিতে হবে। '
নুরুল ইসলাম নাহিদ ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের উদ্দেশে বলেন, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন নিজেদের ক্ষমতাধর মনে না করে। বেশি টাকা নিলে মন্ত্রণালয় থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাবে না বলে যেন আত্মতুষ্টিতে না ভোগে।'
মন্ত্রী বলেন, 'বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির নীতিমালা প্রণয়নের আগে রাজধানীর নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এরপরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালা মানছে না। এটা বড়ই দুর্ভাগ্য।'
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বেশি টাকা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য এখন থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে। টাকা ফেরত না দিলে শাস্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি বাতিল করে লাভ হবে না এ উপলব্ধি থেকে মন্ত্রী বলেন, 'এমপিওভুক্তির আদেশ বাতিল করব না। কারণ, আপনাদের অনেক টাকা আছে। কাজেই এমপিও বাতিল করলে আপনাদের কিছুই যায়-আসে না। আপনাদের প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ও রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া হবে। শিক্ষা বোর্ড থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হবে না। সরকারের বিধি-সার্কুলার, প্রজ্ঞাপন, নিয়ম-নীতি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা করবে না, তাদের ক্ষেত্রে এসব শাস্তি নেমে আসবে। আমাদেরকে তা করতে বাধ্য করবেন না।'
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবার বাংলা মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে ১২ হাজার ৭০০ এবং ইংলিশ ভার্সনে ১৪ হাজার ১০০ টাকা। কেন নেওয়া হচ্ছে-প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষকে মন্ত্রী এ প্রশ্ন করলে অধ্যক্ষ মঞ্জু আরা বেগম বলেন, শিক্ষকদের বেতন এবং উন্নয়নের জন্যই এ টাকা নেওয়া হচ্ছে। তিনিও বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে কোনো কথা বলতে চাননি। পরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের এডহক কমিটির সভাপতি, ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. মুহিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত মানব।' তিনি আরো বলেন, 'ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ৫১৭ শিক্ষকের মধ্যে ৪৪৫ জনকেই সরকার বেতন দেয় না। তাঁদের বেতন দিতে হয় এভাবে টাকা নিয়ে। শুধু বেতন-ভাতা বাবদ মাস শেষে এক কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঘাটতি থাকে। এ টাকা সরকার দিয়ে দিলে আমরা আর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেব না।' তিনি বলেন, 'এসব উল্লেখ করে আমরা সব বিষয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। আশা করব, সরকার আমাদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেবে।'
মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেনও মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সংবাদিক লাঞ্ছনা এবং ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগে মন্ত্রীর ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। মন্ত্রীর বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ হোসেন বলেন, 'নীতিমালার বাইরে টাকা নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার প্রধানমন্ত্রীর অফিসে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে।' অধ্যক্ষ বলেন, 'আমি উভয় সংকটে আছি। সভাপতির কথাও শুনতে হয়, আবার মন্ত্রণালয়ের কথাও শুনতে হয়।' এ পর্যায়ে মন্ত্রী বলেন, 'এসব কথা রাখেন। নীতিমালা করে দেওয়া হয়েছে, সেটা মানতে হবে। না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' এ সময় মন্ত্রী বলেন, 'বেশি টাকা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। দুই-এক দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন পাব। এর পরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' বৈঠক থেকে বেরিয়ে মো. ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার বক্তব্য বলেছি। সব শুনে মন্ত্রণালয় বলছে-অনভিপ্রেত।'
শিক্ষামন্ত্রীর ওই বৈঠকের আলোচনা প্রসঙ্গে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু পাবলিক পরীক্ষায় নয়, ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ কার্যক্রমও বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমরা শুধু এ বছরের টাকা নয় ২০১১ সালেও যেসব প্রতিষ্ঠান ভর্তিতে বেশি টাকা নিয়েছিল, সেসব টাকাও ফেরত চাই। এ ক্ষেত্রে শুধু কথা বললেই হবে না, বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে।'
ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়ার বিষয়ে সরকারের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রধান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. নোমান উর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে। দুই-এক দিনের মধ্যে প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেব।

No comments: