Thursday, July 5, 2012

‘ঈশ্বর কণা’

  • পিটার হিগসের চোখে আনন্দাশ্রু৫ জুলাই বিশ্বের অধিকাংশ সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে রয়েছে ‘ঈশ্বর কণা’। ঈশ্বর কণার প্রায় অভিন্ন একটি কণার আবিষ্কারই যে চার দশকজুড়ে আলোচনায় থাকা এই কণাকে সংবাদ শিরোনাম করেছে এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এ কণার নামটি কি করে ‘ঈশ্বর কণা’ হলো, সে কৌতূহল কি পাঠকের মনে জাগেনি!
পদার্থের ভর কীভাবে তৈরি হয়, তা জানতে সেই ষাটের দশক থেকেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন গবেষকেরা।
হিগস বোসন নামেই যে এ কণার যাবতীয় গবেষণা শুরু হয়েছিল, সে কথা এখন সবারই জানা। কিন্তু তা সবাইকে জানাতে দীর্ঘদিন যেসব মানুষ গবেষণা করেছেন, কলম ধরেছেন তাঁদের মধ্যে লিও লেডারম্যানের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৩ সালে লেডারম্যান এ কণার বিষয় নিয়ে লেখা তাঁর প্রকাশিতব্য বইটির নাম দিতে গিয়ে বেশ সমস্যাতেই পড়েছিলেন। কী নাম দেবেন, তা ভাবতে ভাবতে একসময় খানিক উষ্মাভরেই বোধহয় বলে ফেলেছিলেন, গড ড্যাম পার্টিকেল! আর বলাই বাহুল্য, ঝানু প্রকাশক তা মুহূর্তেই লুফে নিয়েছিলেন। কিন্তু খানিক পরই প্রকাশকের মনে হয়েছিল বাজার কাটতির জন্য চাই আরও স্মার্ট আর ছোট নাম। তো লেডারম্যানের কাছে প্রস্তাব পাড়লেন প্রকাশক। নাম টা একটু ছেঁটে ‘গড পার্টিকেল’ রাখা যায় না? লেডারম্যান সম্মতি দিলেন। বইয়ের নাম রাখা হয়েছিল দ্য গড পার্টিকেল। ব্যস, হু হু করে বাজারে বিক্রি হতে শুরু হয়েছিল সে বই। সেই গড পার্টিকেলের নাম বাংলা করলে দাঁড়ায় এই ঈশ্বর কণা।
৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চের (সার্ন) গবেষকেরা জেনেভায় ঈশ্বর কণা বা হিগস বোসন কণার অনুরূপ একটি কণার আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেন। আর এই ঘোষণা শুনে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ৮৩ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের। চশমা খুলে চোখের জল মুছলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস। এটা তাঁর আনন্দাশ্রু। তিনি বললেন, বেঁচে থাকতে তিনি এই আবিষ্কারের ঘোষণা শুনে যেতে পারলেন, এটাই তাঁর কাছে অনেক বড় পাওয়া। এ তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। যুক্তরাজ্যের নিউ ক্যাসেলে জন্ম নেওয়া হিগস এই কণাটির স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই ১৯৬৪ সালে। তাঁরই এক ছাত্রের কল্যাণে এই কণাটি পরিচিত হতে শুরু করেছিল হিগস বোসন নামে। আর এখন এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িয়ে গেছে তাঁর নাম। সুইজারল্যান্ডের ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চের (সার্ন) গবেষকেরা সংবাদ সম্মেলন করে এই কণার ঘোষণা দেওয়ার সময় চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তিনি।
নতুন কণার আবিষ্কারকে অনেক বিজ্ঞানীই চাঁদে পা ফেলার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করছেন। আবার অনেকেই ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করছেন। পিটার হিগসকে তাঁর অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়ার দাবি করেছেন বর্তমান সময়ের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ স্টিফেন হকিং। অথচ বিজ্ঞানী হকিং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী গর্ডন কেনের সঙ্গে ১০০ ডলারের বাজি ধরে বলেছিলেন, এই কণা কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। হকিং বাজিতে হেরে গেলেও দুঃখ পাননি। তিনি হিগসসহ এই কণা নিয়ে গবেষণারত সব বিজ্ঞানীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
নতুন এ কণাটি আবিষ্কার প্রসঙ্গে গবেষকেরা জানিয়েছেন, পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ কণার আবিষ্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই কণার আবিষ্কারের ফলে অতিপারমাণবিক কণার ধরন বোঝা এবং নতুন প্রযুক্তির উন্মেষের আশা ব্যক্ত করছেন তাঁরা।
পদার্থবিদ্যার যে তত্ত্বটির সাহায্যে কোনো বস্তুর ভরের ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় তাকে ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ বলে। এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলটির অস্তিত্বশীল হতে হলে প্রয়োজন পড়ে হিগস বোসন কণার, যার আরেক নাম ‘গড পার্টিকেল’ বা ঈশ্বর কণা। পদার্থবিদ্যার এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে, মহাবিশ্বে প্রতিটি বস্তুর ভর সৃষ্টির প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে একটি অদৃশ্য কণা। বস্তুর ভরের মধ্যে ভিন্নতার কারণও এই অদৃশ্য কণাটিই। ১৯২৪ সালে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও আলবার্ট আইনস্টাইন বোসন জাতের কণার ব্যাখ্যা দেন। পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস ১৯৬৪ সালে তাত্ত্বিকভাবে এমন একটি কণার ধারণা দেন, যা বস্তুর ভর সৃষ্টি করে। তাঁর মতে, এর ফলেই এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। এ কণাটিই গড পার্টিকেল বা ‘ঈশ্বর কণা’ নামে পরিচিতি পায়। হিগসের এই কণার বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ জানিয়েছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। দুই বিজ্ঞানীর নামে কণাটির নাম দেওয়া হয় হিগস বোসন। ২০০১ সালে এসে গবেষকেরা ওই কণার খোঁজ করতে শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মিল্যাবের টেভাট্রন যন্ত্রে। ২০০৮ সালে প্রতিযোগিতায় নামে সার্ন গবেষণাগারের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। ২০১১ সালে সার্নের বিজ্ঞানীরা এ কণার প্রাথমিক অস্তিত্ব টের পান। একই সময়ে ফার্মিল্যাবও তাদের গবেষণায় ইতিবাচক ফল পায়। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে ৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে সার্নের গবেষকেরাই ঘোষণা দিলেন হিগস বোসনের অনুরূপ একটি কণা আবিষ্কারের।
হিগস বোসন কণার আরেকটি নাম যদিও গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা। কিন্তু ‘ঈশ্বর কণা’ বা গড পার্টিকেল বিষয়টি আদৌ ধর্ম-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নয়। এটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এই নামের পেছনে বেশকিছু মজার বিষয়ও রয়েছে। হিগস ও বোসন দুজন বিজ্ঞানীর নাম মিলিয়ে এ কণার নামকরণ। বোসন হচ্ছে পূর্ণসংখ্যক স্পিন বা ঘূর্ণন-বিশিষ্ট একটি মৌলিক কণিকা। এই কণিকা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। এক শক্তিস্তরে অনেক বোসন একসঙ্গে থাকতে পারে। তাই বস্তুর জাত-পরিচয় দানকারী বোসন নাম নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু হিগসের নাম আলোচনা এলেও বস্তুর ভরের ব্যাখ্যা কেবল স্কটল্যান্ডের বিজ্ঞানী হিগস দেননি। ষাটের দশকে পদার্থের ভর ব্যাখ্যার পেছনে হিগস ছাড়াও কাজ করেছিলেন ফিলিপ অ্যান্ডারসন, জেফ্রি গোল্ডস্টোন, রবার্ট গাউট ও ফ্রাঁসোয়া এঙ্গলার্ট। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টমাস কিবল এবং তাঁর দুই মার্কিন সহযোগী জেরাল্ড গুরালনিক ও কার্ল হাগেন। কণাটির ধারণা তিনি প্রথম প্রকাশ করলেও এ ক্ষেত্রে গবেষণায় অন্যান্য বিজ্ঞানীর অবদান থাকায় এ কণাটির নাম হিগস বোসন রাখার পক্ষে ছিলেন না হিগস। কিন্তু তাঁর এক ছাত্র গবেষণাপত্র লেখার সময় হিগস বোসন কথাটি ব্যবহার করেন। যা পরে প্রচলিত হয়ে যায়। স্ট্যান্ডার্ড মডেল ভরের ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। কণার ভর না থাকলে তা ছোটে আলোর বেগে। অন্য কণার সঙ্গে জোট বাঁধে না। ফলে বস্তু সৃষ্টির তত্ত্ব আর খাটে না। তাই ভরের এই ব্যাখ্যা পেতে এমন একটি কণার সন্ধান করছিলেন গবেষকেরা, যাকে ১৯৯৩ সালে বিজ্ঞান লেখক লিও লেডারম্যান নাম দেন গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা। ভরের ব্যাখ্যা পেতে হলে ঈশ্বর কণার ব্যাখ্যা জরুরি ছিল।
২০০৮ সাল থেকে রহস্যময় কণাটির খোঁজ পেতে মহাযজ্ঞের আয়োজনই করে বসেছিলেন সার্নের গবেষকেরা। মাটির নিচে বিশাল সুড়ঙ্গে বসানো লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে আলোর গতিতে দুটি বিপরীতমুখী প্রোটন বা অতিপারমাণবিক কণার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে বিগ ব্যাং বা মহাজাগতিক বিস্ফোরণের পরবর্তী অবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা। এই সংঘর্ষে কী তৈরি হতে পারে, তা আলবার্ট আইনস্টাইন আগেই বলে গিয়েছেন। বিপুল পরিমাণ শক্তি ও অসংখ্য অতিপারমাণবিক কণার জন্ম। এসব কণার মধ্যে আবার পারস্পরিক সংঘর্ষে তৈরি হয় নতুন কণার। কিন্তু বিজ্ঞানীরা খুঁজছিলেন এমন একটি কণাকে, যাকে আমরা বলছি ভর সৃষ্টিকারী বোসন বা ‘ঈশ্বর কণা’।
৪ জুলাই গবেষকেরা ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদের হাতে গবেষণালব্ধ যে ফলাফল এসেছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট তাঁরা। তবে হিগস বোসন বা ঈশ্বর কণা বা ঈশ্বর কণার অনুরূপ—যা-ই হোক, একটা কিছুর সন্ধান তাঁরা নিশ্চিতভাবেই পেয়েছেন। তবে এখানেই তাঁরা থেমে যেতে চান না। এবার তাঁদের লক্ষ্য আরও নতুন কিছু, নতুন কোনো কণা।

No comments: