Sunday, January 22, 2012

মাদক জালে পল্লবী


সারিবদ্ধ খুপরি ঘরগুলোর পাশেই বালুর মাঠ। একপাশে ঝিল। রাজধানীর পল্লবীর মিল্কভিটার পাশের বস্তির পরিচিত মাদক স্পট। এ স্পটকে সবাই মফিজ আর নজরুলের স্পট বলেই চেনে। গত বুধবার দুপুরে সেখানে এক কোণে কয়েকজন তরুণ গোল হয়ে বসে ছিল। রাস্তার পাশে একটি ছাই রঙের মাইক্রোবাস দাঁড়াতেই সবাই পালানোর চেষ্টা করে। মাইক্রোবাস থেকে নেমে সাদা পোশাকের কয়েকজন সদস্য ধরে ফেলে দুই তরুণকে। এরপর মাইক্রোবাসটি চলে যায় সোজা ১০ নম্বর সেকশনের ১ নম্বর লাইনের সি ব্লকে। পিছু নিয়ে জানা গেল, গাড়িতে তোলা একজনের নাম জাহিদ। পল্লবী থানার সিভিল টিম গাঁজাসহ ধরেছে তাকে। তার মা ও বোন গাড়ির কাছে গিয়ে বলে, 'স্যার, ও আর যায় নাই। ছাইরা দেন। জীবনে আর যাইব না।' সিভিল টিমের একজন বলেন, 'একা একজন সামনের কালভার্টের কাছে আসেন। ছাইড়া দেব।' এরপর 'রফা-দফা'। দুপুরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দুই তরুণকে। তবে কত টাকায় মুক্তি মিলল তা বলতে নারাজ জাহিদ ও তার স্বজনরা। পরে ঘটনাটি জানতে চাইলে সিভিল টিমের (রোমিও) দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক কামরুল ইসলাম বলেন, 'স্টিকসহ (গাঁজা) দুজনকে ধরছিলাম। পরে ছেড়ে দিছি। টাকা-পয়সার কোনো ব্যাপার নাই ভাই। ওরা তো গরিব মানুষ।'
এ ঘটনার মতোই পল্লবীতে মাদকবাণিজ্য নিয়ে চলছে 'চোর-পুলিশ খেলা'। মাদকের ভয়াল থাবা এ এলাকার প্রতিটি অলিগলিতে। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় অর্ধশত স্পটে মাদক বিক্রি ও সেবন চলছে। মাদক ব্যবসায়ীও অর্ধশতাধিক। ৬ নম্বর সেকশন, ৭ নম্বর সেকশন, মিল্কভিটা, সিরামিক, ৩ নম্বর ওয়ার্ড ঝিলপাড়, জল্লাদ ক্যাম্প, এফ ব্লকের বিহারি পল্লীর ওয়াপদা গলি, প্যারিস রোড, কালাপানির ঢাল, সাংবাদিক কলোনি, লাইনবাড়ী, ইস্টার্ন হাউজিং বস্তি, ৮ নম্বর ওয়ার্ড বস্তির বালুর মাঠসহ আশপাশে প্রকাশ্যেই চলছে মাদক বিকিকিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা, মাদকসেবী ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পল্লবীর বিভিন্ন মাদক স্পটে এখন গাঁজা, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের চাহিদাই বেশি। এসব বিক্রি হয় ছদ্মনামে। গাঁজার নাম পোঁটলা। ইয়াবাকে ডাকে সবাই ট্যাবলেট বলেই। আর দিনের বেলাও অলিগলিতে 'ঠাণ্ডা' বলে বিক্রি করা হয় ফেনসিডিল। মাদকের সহজলভ্যতার কারণে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, নারী, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণীর মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় থানার পুলিশকে ম্যানেজ করেই মাদক স্পটগুলো চলছে। পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্সরাও জড়িত এসব মাদক স্পটের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান চলানো হলেও বিক্রেতা সিন্ডিকেট ভাঙছে না কোনো মহল্লারই। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও বিরোধকে কেন্দ্র করে গত এক দশকে অন্তত ২০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গত দুই বছরেও ঘটেছে এমন একাধিক হত্যাকাণ্ড।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ২০ অক্টোবর ১১ নম্বর সেকশনের ১২ নম্বর রোডের এফ ব্লকের বিহারি পল্লীর ৪ নম্বর ওয়াপদা গলিতে রাতে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মোহাম্মদ শওকত নামের এক বৃদ্ধকে। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল মাদকবাণিজ্য। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ার কারণে কালু, শহীদ, লিটন, জাবেদ, জাকির, জলিল, জামাল, নাদিমসহ ১৩-১৪ জন মিলে হত্যা করে শওকতকে। স্থানীয় পুলিশ সোর্স সাইফুল, জাহিদ, পুটুও এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ স্বজনদের। এ ঘটনার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরো এলাকাটি মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, শওকত হত্যাকাণ্ডে আসামি ও সন্দেহভাজনরাই এলাকার বড় মাদক ব্যবসায়ী। বাহারের ছেলে কালু, শহীদ ও লিটন প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করে। তাদের মা আজুদা সন্তানদের অপকর্মে মদদ দেয়। পরিবারটি মাদক ব্যবসার কারণে এলাকায় চিহ্নিত। দিনের বেলাও এ গলির মধ্যে 'ঠাণ্ডা' বলে ফেরি করে ফেনসিডিল বিক্রি করা হয়। ২০১০ সালেরই ৮ অক্টোবর পুলিশ কালুদের বাসা ও বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক ফেনসিডিল উদ্ধার করে। ওই ফেনসিডিল উদ্ধারের ঘটনায় থানায় মামলা হয়, যে মামলায় আসামি শওকতের আরেক ভাতিজা রাশেদ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়ার কারণেই শওকতকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি তার স্বজনদের। স্থানী লোকজন জানায়, মাদক ব্যবসার সঙ্গে শওকতের স্বজনরাও জড়িত বলে অভিযোগ আছে। ২০১০ সালেরই জুন মাসে মাদক ব্যবসার বিরোধে ওই এলাকায় খুন হয় পুলিশ সোর্স সুমন। শওকতের ভাই কাওসারের ছেলে হীরা ওই হত্যা মামলার আসামি।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, মাদকের ভয়াল বিস্তারের শিকার হচ্ছে অনেক পরিবার। উঠতি বয়সের তরুণরাই বেশি মাদকাসক্ত হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় রাস্তার পাশে পড়ে থাকছে ফেনসিডিলের খালি বোতল। উৎকণ্ঠায় আছেন স্থানীয় অভিভাবকরা। মাদক স্পটগুলোর বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ সন্ত্রাসীদের হাতে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে ছাড়া পেয়ে চিহ্নিতরাই চালায় মাদকবাণিজ্য। আছে সোর্স ও সরকারদলীয় ক্যাডার পরিচয়দানকারীদের নিয়ন্ত্রণ।
অলিগলিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬ নম্বর সেকশনে শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাতক শাহাদতের সেকেন্ড ইন কমান্ড বলে পরিচিত মুক্তারের সহযোগীরা প্রকাশ্যে চালাচ্ছে মাদক ব্যবসা। ফেনসি মুন্না, রাসেল মোড়ল, আলামিন বাবু ওরফে ফাটা বাবু, মোহর বাবু, ল্যাংড়া রফিক উল্লেখযোগ্য। এদের বিরুদ্ধে মিরপুরের বিভিন্ন থানায় মাদক ও চাঁদাবাজিসহ বেশ কিছু মামলা আছে। সাংবাদিক আবাসিক এলাকার পাশে বড় মাদক স্পটটি চালায় একটি মাদক পরিবার। বাহারের ছেলে কালু ও শহীদ এ স্পটের নিয়ন্ত্রক। গত মাসে শহীদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। সিরামিক মাদক স্পটে কান্সী এবং বালুর মাঠ বস্তিতে আবদুুল্লাহ গাঁজার ব্যবসা চালায়। সুমন মিয়ার নিয়ন্ত্রণে ইয়াদ আলীর স্পটে ঠাণ্ডার (ফেনসিডিল) বাণিজ্য। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ঝিলপাড় বস্তিতে হেরোইন বিক্রি করে গোলাপি। সূত্রে জানা যায়, জল্লার ক্যাম্পে বাংলা মদ বিক্রি করে আরেক নারী রহিমা। অবাঙালি মুসলিম ক্যাম্পে হেরোইন বিক্রেতা আরমান। সর্দার মাদক স্পটের ফেনসিডিল সরবরাহকারী বিপন আলী সর্দার। প্যারিস রোড কালির স্পটে মনির উদ্দিনের স্ত্রী চোলি গাঁজার পোঁটলার ব্যবসায়ী। ১২ নম্বর সেকশনের ৩ নম্বর ব্লকের হেলেনা ও জোহরার গাঁজার স্পট বেশ পরিচিত। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জিন্নাহ ক্যাম্পে বাংলা মদ সরবরাহ করে সিরাজ। তালতলা বস্তির স্পটে হেরোইন সরবরাহ করে আফজাল। এফজি মাহিলা স্পটে মাহিলা বেগম এবং পুকুরপাড় এলাকায় ফজল ওরফে ফজলুর রহমান বাংলা মদ বিক্রি করে। লাইনবাড়ী স্পটে গাঁজা বিক্রি করে আমির হোসেন। পাশেই আছে রুকসানার গাঁজা বিক্রির স্পট। ১০ নম্বর সেক্টরে সুরুজ মিয়া চালায় ফেনসিডিল চালান। জানা গেছে, রহমত ক্যাম্প স্পটে হেরোইন সরবরাহ করে শহীদ ও আয়েশা। আদর্শনগর সুবাহান স্পটে হাফিজ উদ্দিন ওরফে সুবাহান হেরোইন বিক্রি করে। মিল্লাত ক্যাম্প স্পটে সারোয়ার, ওয়াপদা বিল্ডিং স্পটের কাওসার হেরোইন বিক্রেতা। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মিল্কভিটা রোডের ঝিলপাড় বস্তিতে শহীদ স্পট নামে গাঁজা বিক্রির আরো একটি স্পট আছে। একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে অপকর্ম চালায় এই শহীদ। ঝিলপাড়ের বস্তিতে মফিজ ও নজরুলের গাঁজার স্পটটিও চাঙ্গা। ৭ নম্বর সেকশনের মিল্কভিটা রোডের জিতার গার্মেন্টের পাশের স্পটের মুসলিমও এলাকায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। হাউজিং বস্তিতে ফেনসিডিল বিক্রি করে ফাজেম আলী। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বালুর মাঠে নাছিমা ও শাহাবুদ্দিন গাঁজা বিক্রি করে। সারেংবাড়ী বস্তিতে বাংলা মদ বিক্রি করে মনির হোসেন। আলকাছ ফেনসিডিল বিক্রি করে শাহআলীর লালাবাগে। শিয়ালবাড়ী বস্তিতে হেরোইন বিক্রি করে সাগর। এ ছাড়া মালিকের আস্তানায় মনির হোসেন এবং ফাতেমা বস্তিতে ফাতেমা ওরফে ফতে গাঁজার জোগানদাতা। স্থানীয় কয়েকজন মাদকসেবী জানায়, মাদক স্পটগুলোতে হেরোইনকে পাউডার, ফেনসিডিলকে ঠাণ্ডা, ইয়াবাকে ট্যাবলেট এবং গাঁজাকে পোঁটলা, পাতা ও স্টিক বলে সাংকেতিক নামে ডাকা হয়। প্রতিটি স্পটের মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে মাসোয়ারা আদায় করে। স্থানীয় থানা-পুলিশ, গোয়েন্দাসহ সবার কাছেই এসব মাদক ব্যবসায়ীর তথ্য আছে বলে দাবি করে তারা।
প্রশাসনের বক্তব্য : পল্লবী থানার ওসি শাহাবুদ্দিন খলিফা মাদক স্পট থেকে সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিয়মিতভাবেই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। প্রায় প্রতিদিনই মাদক ও মাদক বিক্রেতা গ্রেপ্তার হচ্ছে। অনেক স্পট বন্ধ হয়ে গেছে বলেও দাবি করেন তিনি। ওসি বলেন, অভিযান চলার কারণে শহীদের মতো মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা গেছে। এখন আগের তুলনায় ৩০ শতাংশ মাদক ব্যবসা আছে বলে দাবি করেন ওসি।
পল্লবী থানার পুলিশ জানায়, গত এক সপ্তাহে রহমত ক্যাম্প স্পট থেকে ১২৩ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে পুলিশ। জয়ন্তিকা মোড় থেকে ১৩ কেজি গাঁজা এবং কালশি এলাকা থেকে ১৪০ বোতল বাংলা মদ উদ্ধার করে পুলিশ। গত সপ্তাহে মফিজসহ কয়েকজন মাদক বিক্রেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের মিরপুর সার্কেলের পরিদর্শক ওসমান কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, 'চারটি থানার বড় এলাকায় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না সব সময়। পল্লবীতে প্রায়ই অভিযান চালাই আমরা। মাঝেমধ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা হয়।' তবে সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযানের কথা জানাতে পারেনি এ পরিদর্শক।

No comments: