Sunday, January 22, 2012

সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ

ইহকালীন জীবনে যেসব সৎ কাজ রয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে নিজে পালন করা ও অন্যকে পালন করার জন্য সদুপদেশ প্রদান করা এবং দুনিয়ায় যেসব অসৎ কাজ রয়েছে, সেগুলো থেকে নিজে বিরত থাকা ও অন্যকে বিরত রাখাই হলো মানবজীবনে উন্নতির উপায়।
মানুষ দুনিয়ায় সত্য কথা বলবে, আমানত রক্ষা করবে, ওয়াদা পালন করবে। শুধু নিজেই এগুলো মেনে চললে হবে না, অপরকেও এসব সৎ কাজ পালন করার জন্য উপদেশ দিতে হবে। পক্ষান্তরে সে মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকবে, কারও গিবত তথা পরচর্চা ও পরনিন্দা করবে না, কারও গচ্ছিত সম্পদ নষ্ট বা আত্মসাৎ করবে না। ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি প্রভৃতি সামাজিক অনাচার বর্জন করবে এবং এসব অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য অন্য ব্যক্তিদেরও সদুপদেশ দেবে। তাহলে মানবজাতি উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করবে। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক হোক, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে, আর তারাই সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৪)
পিতামাতা তাঁদের সন্তানকে আল্লাহ ও রাসুলের আদর্শ তথা ধর্মীয় শিক্ষা দেবেন। সর্বপ্রথম তাঁদের ঈমান ও আকিদা-বিষয়ক শিক্ষা দেবেন। এরপর কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ ইসলামের পঞ্চস্মম্ভের যাবতীয় সৎ কাজের শিক্ষা দেবেন এবং মিথ্যা বলা, চুরি-ডাকাতি করা, গালিগালাজ করা ইত্যাদি যাবতীয় অসৎ কাজ হতে দূরে রাখবেন। ইসলামে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। সন্তানকে বাল্যকাল থেকে নামাজের আহকাম-আরকান ও নিয়মকানুন শেখাতে হবে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে হজরত লুকমান (আ.)-এর সদুপদেশ ব্যক্ত করে ইরশাদ করেছেন, ‘হে আমার বৎস! তুমি নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজ হতে বিরত রাখো এবং বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করো, নিশ্চয়ই এটা দৃঢ়সংকল্পের কাজ।’ (সূরা লুকমান, আয়াত-১৭)
আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করে তাকে জ্ঞানদান করে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। কোন্ কাজ ভালো আর কোন্ কাজ মন্দ তা বলে দিয়েছেন, তারপরও মানবজাতি যুগে যুগে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভুলে গেছে, তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করেছে। শয়তানের প্ররোচনা ও ধোঁকায় পড়ে বিপথগামী হয়েছে। তাই পথভোলা মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুলকে পাঠিয়েছেন এবং মানবতার কল্যাণের জন্য ঐশী ধর্মগ্রন্থ তথা আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে সৎ কাজ মানে ভালো কাজ, যেসব কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল পছন্দ করেন, যাতে বিশ্বমানবতার কল্যাণ সাধন হয়।
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরে আর কোনো নবী আসবেন না, কোনো ঐশী ধর্মগ্রন্থও আসবে না। তাই সৎ কাজের আদেশ দান এবং অসৎ কাজে নিষেধ করার দায়িত্ব সর্বশেষ নবীর উম্মতের ওপর পড়েছে। এটি উম্মতে মুহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শয়তান সব সময় মানুষকে ধোঁকা দিয়ে পাপকাজের প্রতি আকৃষ্ট করে। এতে মানুষ কুপ্ররোচনায় পড়ে সৎ কাজ থেকে বিরত থাকে এবং অসৎ কাজে লিপ্ত হয়। এ জন্য সব সময়ই মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিতে হবে, উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দান করতে হবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে ও বাধা দিতে হবে—এটি ইসলামের মৌলিক শিক্ষা।
ইসলামে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার মধ্যে মুসলিম উম্মাহর সঞ্জীবনী শক্তি নিহিত। অসত্য, অন্যায়, অত্যাচার, অশ্লীলতা ও পাপাচারে বাধা না দিলে এবং দুর্বার প্রতিরোধ-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে অন্যায়কারীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে আরও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে উৎসাহী হয়। ফলে মানবসমাজে অন্যায়-অপরাধে অসৎ কাজের অধিক্য দেখা দিলে এসব সামাজিক অনাচার প্রতিহত করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে সৎ কাজের আদেশ না দিলে বা সৎ কাজে উৎসাহিত না করলে দুর্বল চরিত্রের লোকেরা ধর্ম-কর্ম ত্যাগ করে সৎ কাজ করতে ভুলে যায় এবং সৎ কাজের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে অন্যায় অপরাধমূলক যাবতীয় অনৈতিক অসৎ কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তীব্র গণপ্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি কাউকে অন্যায় করতে দেখে, তবে হাতে বল প্রয়োগে ফেরাবে, যদি সে সামর্থ্য না থাকে তবে মুখে সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, যদি সে সামর্থ্যও না থাকে তাহলে মনে মনে খারাপ জানবে। আর এটাই দুর্বলতম ঈমানের পরিচায়ক।’ (মুসলিম)
আজকাল সমাজে অপরাধীচক্র সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে অন্যায় ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ করা অনেক সময় অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে পড়ে। এ জন্য দলবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। আর যারা ভালো কাজ করে, তাদের পুরস্কৃত করা এবং যারা খারাপ কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিতে হলে আগে নিজে সৎ হতে হবে, তা না করা হলে সুফল পাওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে অপরকে অসৎ কাজে নিষেধ করলে আগে নিজে অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। নিজে অসৎ হয়ে অন্যকে অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা যায় না। তাই আসুন, দশে মিলে কল্যাণকর সৎ পথের সন্ধানে নিজেদের ব্যাপৃত করি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments: