Norshingdi |
পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ গোয়েন্দা দল গত রোববার রাতে ঢাকার খিলগাঁও থেকে নাজমুল হোসেন শরীফ নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে শরীফ এ তথ্য দিয়েছেন। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি অনুযায়ী, শরীফই গুলি করে লোকমানকে হত্যা করেছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, কয়েক মাস আগে লোকমান হত্যার পরিকল্পনা চলছিল। দুটি স্তরে এ কাজ চলে। একটি স্তর পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল, আরেকটি স্তর ছিল বাস্তবায়নে। তদন্তে এখন পর্যন্ত বাস্তবায়নকারী ও হত্যা-প্রক্রিয়ায় জড়িতদের শনাক্ত করা গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। মোবারক হোসেন গ্রেপ্তার না হলে মূল পরিকল্পনাকারীদের শনাক্ত করা কঠিন হবে। লোকমান হত্যার কয়েক দিন আগে মোবারক মালয়েশিয়ায় চলে যান।
পুলিশ সূত্র জানায়, খুনি ভাড়া করার ক্ষেত্রেও বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। লোকমানকে হত্যার জন্য ঢাকার পেশাদার একটি সন্ত্রাসী দলকে ২০ লাখ টাকা আগাম দেওয়া হয়, কিন্তু খুন করানো হয় আরেকটি সন্ত্রাসী চক্রকে দিয়ে। তদন্তকারীদের ধারণা, হত্যার নেপথ্য নায়কদের আড়ালে রাখতে দুটি পৃথক সন্ত্রাসী দল ভাড়া করা হয়। এতে পরিকল্পনা ফাঁস হলেও আলোচনায় বা সন্দেহের তালিকায় প্রথম দলটি থাকবে।
শরীফ নরসিংদীতে ‘কিলার’ শরীফ হিসেবে পরিচিত। গতকালই তাঁকে নরসিংদী পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নরসিংদীর পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, শরীফই লোকমানকে গুলি করেছেন। খুনের ঘটনায় তাঁর ব্যবহূত রিভলবারসহ অন্যান্য আলামতও উদ্ধার করা হয়েছে। শরীফের দুই সহযোগী আওলাদ হোসেন ও সারোয়ারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মামলার এজাহারে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের ভাইসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যেসব ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মোবারকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। মোবারককে গ্রেপ্তার করা গেলে পরিকল্পনার স্তরে বাকি কারা জড়িত, তা বেরিয়ে আসবে।
এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া শহর যুবলীগের সভাপতি আশরাফ সরকার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, হত্যা পরিকল্পনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী আরও অনেকের সায় ছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতদের জবানবন্দিতে এজাহারভুক্ত ও এজাহারের বাইরের অনেকের নামই এসেছে। তদন্তের স্বার্থে এসব নাম বলতে পারছি না।’
শরীফ যেভাবে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার হন: সূত্র জানায়, আশরাফ সরকারের জবানবন্দি অনুযায়ী, লোকমান হত্যার জন্য ঢাকার সন্ত্রাসী নবী গ্রুপের হাজি ফারুকের সঙ্গে চুক্তি করেন মোবারক ও আশরাফ সরকার। তাঁরা হত্যার দুই মাস আগে ঢাকায় ওই দলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন। একপর্যায়ে হাজি ফারুককে তাঁরা আগাম ২০ লাখ টাকা দেন। এরপর ফারুক ও তাঁর লোকজন একাধিকবার নরসিংদী গিয়ে লোকমানের চলাফেরা আগাম পর্যবেক্ষণ (রেকি) করে আসেন। তাই লোকমান হত্যার পর এই পেশাদার চক্রের নাম আলোচনায় আসে। ফারুক ও তাঁর সহযোগী মাহফুজসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ গোয়েন্দা দল। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে এঁদের কাছ থেকে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, এরই মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি আশরাফ সরকার রিমান্ডে একপর্যায়ে জানান, লোকমান হত্যার পর মালয়েশিয়া থেকে ফোন করে মোবারক তাঁকে বলেছিলেন, ‘কিলার শরীফ ও হীরুরা ঘটনা ঘটিয়েছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরপর তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মালয়েশিয়া থেকে মোবারকের ফোনে যোগাযোগের সূত্র ধরে শরীফের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। রোববার রাতে সহযোগী আওলাদসহ শরীফকে ঢাকার খিলগাঁও নন্দীপাড়ার জনৈক ওমর ফারুকের বাসা থেকে আটক করা হয়।
সূত্রমতে, জিজ্ঞাসাবাদে শরীফ জানিয়েছেন, খুনে ব্যবহূত অস্ত্রটি (পয়েন্ট ৩২ বোরের রিভলবার) তাঁর তাবলিগের কথিত সাথি সারোয়ারের কাছে রেখেছেন। এরপর সারোয়ারকে গাজীপুরের চাপুলিয়া বাজারের কাছে তাঁর শ্যালকের বাসা থেকে আটক করা হয়। ওই বাড়ি থেকেই খুনের সময় শরীফের ব্যবহূত কালো শার্ট, গেঞ্জি ও মুখোশ (মাংকি ক্যাপ) উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারের পর শরীফ প্রথমে দাবি করেন, রিভলবারটি পানিতে ফেলে দিয়েছেন। পরে জেরার মুখে স্বীকার করেন, রিভলবারটি দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন তাঁদের আরেক তাবলিগি সাথি বেলায়েত হোসেনের কাছে। গতকাল ভোরে নরসিংদীর ঘোড়াদিয়া থেকে বেলায়েতকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁর কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহূত জার্মানির তৈরি রিভলবার ও ২২টি গুলি উদ্ধার করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ গোয়েন্দা দলটি এই তিনজনকে গতকাল সকালে নরসিংদী পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
লোকমানের সঙ্গে বিরোধ: জিজ্ঞাসাবাদে শরীফ তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেন, তাঁর সঙ্গে একসময় লোকমানের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ২০০৩ সালে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জের ধরে বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতার প্রতিপক্ষ জয়নাল চেয়ারম্যান খুন হন। বদলা হিসেবে জয়নাল চেয়ারম্যানের অনুসারীরা বিএনপির ওই নেতার ক্যাডার জসিমকে হত্যা করে। শরীফ দাবি করেন, তিনি ওই হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিলেন না, কিন্তু লোকমান তাঁকে জসিম হত্যা মামলায় আসামি করান। মামলায় শরীফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। পরে শরীফ উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান।
পুলিশের কাছে শরীফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের শুরুর দিকে নরসিংদীতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে রনি নামের এক সন্ত্রাসী খুন হয়। লোকমান প্রভাব খাটিয়ে ওই মামলায়ও শরীফকে আসামি করান। এ নিয়ে লোকমান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারেকের সঙ্গে শরীফের ঝগড়া হয়। শিবপুর এলাকার বালু ব্যবসা নিয়েও লোকমানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। একবার তাঁকে ডেকে নিয়ে অস্ত্রসহ পুলিশেও দিয়েছিলেন লোকমান। এ ক্ষোভ থেকেই তিনি মোবারকের প্রস্তাবে রাজি হন।
লোকমানের ঘনিষ্ঠ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা এস এম কাইউম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর জেল খেটে বের হওয়ার পর শরীফ তাবলিগ জামাতের বেশ ধারণ করেন। কিন্তু আড়াই বছর ধরে চলাফেরা করতেন মোবারকের সঙ্গে। মোবারকই শরীফকে টাকা-পয়সা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। বছর খানেক আগে এলাকায় আলোচনা ওঠে, মোবারক একটি অস্ত্র কিনে দিয়েছেন শরীফকে।
গ্রেপ্তারের পর শরীফ পুলিশকে জানান, মোবারকের সঙ্গে লোকমানের বন্ধুত্ব ছিল। পরে দরপত্র নিয়ন্ত্রণসহ ব্যবসায়িক বিরোধ তৈরি হয়। এ ছাড়া মোবারকের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে লোকমানের ঘনিষ্ঠ তারেকের সম্পর্ক ছিল বলে সন্দেহ করতেন তিনি। মোবারক বিষয়টি লোকমানকে কয়েকবার বলেও প্রতিকার পাননি। এ নিয়েও মোবারক ক্ষুব্ধ ছিলেন লোকমানের ওপর।
যেভাবে খুন: পুলিশ সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে শরীফ বলেছেন, গত অক্টোবরের মাঝামাঝি লোকমান হত্যার বিষয়ে মোবারকের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয়। মোবারক তাঁকে জার্মানির তৈরি একটি রিভলবার ও ৩০টি গুলি দেন। দেন একটি মোটরসাইকেলও। সেটি শরীফ টঙ্গীতে মোবারকের ভাতিজি জামাই হাজি সেলিমের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন।
২৯ অক্টোবর শরীফ তাঁর সহযোগী আওলাদকে পৌরসভায় পাঠান লোকমান সেখানে আছেন কি না দেখতে। মেয়র লোকমান তখন কার্যালয়ে ছিলেন না। ঘটনার দিন ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শরীফ তাঁর ভাই হীরু ও আওলাদকে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে পাঠান লোকমান আছেন কি না দেখতে। তাঁর মোবাইল ফোনে শরীফকে জানান, লোকমান দলীয় কার্যালয়ে আছেন। শরীফের দাবি, লোকমান হত্যা পরিকল্পনার কথা আগে থেকে হীরু ও আওলাদ জানতেন না। শরীফ তাঁদের বলেছিলেন, তিনি মামলাসংক্রান্ত কাজে লোকমানের কাছে যাবেন।
শরীফের দাবি অনুযায়ী, খবর নেওয়ার পর রাত আটটার দিকে মোটরসাইকেলে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে যান শরীফ। রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছিল, লোকমান অফিসে বসে আছেন। মোটরসাইকেলটি কাছাকাছি রেখে মাংকি টুপি (মুখোশ) পরে কার্যালয়ে ঢুকেই লোকমানকে লক্ষ্য করে চার-পাঁচটি গুলি করেন শরীফ। বেরিয়ে আসার সময় কিছু লোক পিছু নেওয়ার চেষ্টা করলে দুটি ফাঁকা গুলি করে পালিয়ে যান। সেখানে থেকে তাবলিগের কথিত সাথি ভাই সারোয়ারের বাসায় যান। অস্ত্র ও পরনের জামাকাপড় ওই বাসায় রেখে শরীফ তাবলিগে যাওয়ার কথা বলে খিলগাঁওয়ে গিয়ে ওঠেন।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এস এম কাইউম প্রথম আলোকে বলেন, লোকমানকে হত্যার পৌনে এক ঘণ্টা আগে তিনি দলের কার্যালয়ে ছিলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সামনে রাস্তায় তিনি শরীফের ভাই হীরুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। এই তথ্য তিনি হত্যাকাণ্ডের পর র্যাবকেও জানিয়েছিলেন বলে জানান। হীরু এলাকায় ছিঁচকে সন্ত্রাসী ও মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শরীফের সন্ত্রাসী দলটি সম্প্রতি তাবলিগ জামাতের লোকের বেশ ধারণ করেছে। শরীফের দাবি, তিনি ভোলার চরফ্যাশনের কলেজশিক্ষক আবদুল মজিদের অনুসারী।
আবদুল মজিদ মূলত কালেমার দাওয়াত নামে একটি সংগঠনের প্রধান। এটিকে তাঁরা তাবলিগি সংগঠন বলে দাবি করেন।
মোট গ্রেপ্তার: লোকমান হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন ১৬৪ ধারায় লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন। এঁরা হলেন: এজাহারভুক্ত আসামি আশরাফ হোসেন সরকার, সন্দেহভাজন আসামি হাজি সেলিম মিয়া, মাহফুজ মিয়া, হাজি ফারুক, কাজী আলম।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নরসিংদী প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান]
No comments:
Post a Comment